সালাত আদায়ের সঠিক নিয়ম (চিত্রসহ)
আসসালামু আলাইকুম আশা করি মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনারা সকলেই ভালো আছেন সুস্থ আছেন। আজকে আমি আবারও আপনাদের জন্যে একটি ইসলামিক টিউন নিয়ে হাজির হয়েছে। আমরা অনেকেই হয়তো নামাজ পড়ার সঠিক বা নির্ভুল নিয়মটা জানি না। আবার আমরা যখন মসজিদে যায় তখন দেখতে পাই অনেকেই অন্য নিয়মে নামাজ আদায় করতেছে। সবার নামাজ পড়ার নিয়ম এক হয় না। তখন আমাদের মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে যে আসলে নামাজ আদায় করার সঠিক নিয়মটা কি? আপনাদের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য বা আপনাদের মন থেকে নামাজ পড়ার ভুল নিয়মটা দুর করার জন্য আমি "চিত্রসহ পুরুষদের নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম" এই টিউনটি আমার ব্লগে পাবলিশ করে দিলাম।
তঃ চলুন নামাজের ৭ টি ফরয সঠিক নিয়মে আদায় করার নিয়মটি ধাপে ধাপে জেনে নিই -
১ম ফরজঃ তাকবীরে তাহরীমা
নামাজের ভিতরে সাতটি ফরজ। ১ম ফরজঃ তাকবীরে তাহরীমা-’আল্লাহু আকবর’। নামাজ শুরু করার সময়ঃ
১৷ মনে মনে নিয়ত করবে যে, আমি অমুক নামাজ পড়ছি। মুখে নিয়্যতের ভাষা (আরবীতে) উচ্চারণ করা জরুরী নয়, তবে মুস্তাহাব।
২৷ দুই হাত কান বরাবর এমনভাবে উঠাতে হবে যাতে উভয় হাতলী কিবলার দিকে হয়, আঙ্গুলগুলোর মাথা যেন কিবলামুখী ও স্বাভাবিকভাবে ফাঁক থাকে। অর্থ্যাৎ বৃদ্ধাঙ্গুলী দুইটির মাথা কানের লতির সাথে হয়তো একেবারে মিলে যাবে অথবা বরাবর হবে, বাকী আঙুলগুলো উপরের দিকে থাকবে।
৩৷ কান থেকে হাত সোজা হাত বাঁধার দিকে নিয়ে যাবে, হাত সোজা নীচের দিকে ছেড়ে দেবে না বা পিছনের দিকে ঝাড়া দেবে না।
৪৷ উপরোক্ত নিয়মে হাত তোলার সময় আল্লাহু আকবর বলবে। অতঃপর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলী ও কনিষ্ঠ আঙ্গুলী দ্বারা হালকা বানিয়ে বাম হাতের পাঞ্জাকে ধরবে এবং অবশিষ্ট তিনটি আঙ্গুল বাম হাতের পিঠের ওপর স্বাভাবিকভাবে বিছিয়ে রাখবে যাতে আঙ্গুলের মাথা গুলো কনুই-এর দিকে থাকে।
৫৷ উভয় হাত নাভীর সামান্য নীচে পেটের সাথে কিছুটা চেপে ধরে উপরোক্ত নিয়মে বাঁধবে।
৬৷ একাকী নামাজ পড়লে অথবা ইমামতী করলে প্রথমে সুবহানাকা, আউযুবিল্লাহ্, বিছমিল্লাহ্, সূরায়ে ফাতিহা ও অপর একটি সূরা পড়বে। মুক্তাদী হলে (ইমামের পিছনে হলে) সুবহানাকা পড়ে চুপ করে একাগ্র মনে ইমামের কিরআত শুনতে থাকবে। সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করার পর ইমাম ও মুক্তাদীগণ মৃদুস্বরে আমীন বলবে।
২য় ফরজঃ দাড়িয়ে নামাজ পড়া
২য় ফরজঃ দাড়িয়ে নামাজ পড়া। দাঁড়ানো অবস্থায়ঃ
১৷ দাঁড়ানো অবস্থায় প্রথমে অবশ্যই কিবলামুখী হতে হবে।
২৷ অতঃপর দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদাহর জায়গায় থাকবে। গর্দান সামান্য ঝুঁকিয়ে রাখতে হবে। থুতনীকে সীনার সাথে মিলিয়ে রাখা মাকরুহ। নামাজের নিয়্যত বাঁধার পূর্ব পর্যন্ত হাত ছাড়া অবস্থায় রাখতে হবে।
৩৷ পা ও পায়ের আঙুলগুলো কিবলামূখী থাকবে। পা অবশ্যই সোজা রাখতে হবে।
৪৷ উভয় পায়ের মাঝখানে কমপক্ষে চার আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখতে হবে। সামনে ও পিছনে সমান ফাঁক রাখতে হবে যাতে পা সোজা কিবলামুখী হয়।
৫৷ জামায়াতে নামাজ পড়ার সময় সোজা হওয়া প্রয়োজন, কাতার সোজা করার সহজ পদ্ধতি যেমন- প্রত্যেকে নিজ নিজ পায়ের গোড়ালীর শেষ মাথা এক বরাবর রাখবে।
৬৷ জামায়াতের সময় ডানে বামে পরস্পরের বাহুগুলো সমান থাকবে। দুই বাহুর মাঝখানে কোন ফাঁক থাকবে না।
৭৷ পায়জামা অথবা লুঙ্গি টাকনু (গোড়ালি) উপরে থাকবে।
৮৷ হাতের আস্তিন সম্পূর্ণ লম্বা হওয়া চাই যাতে কবজি বরাবর ঢেকে থাকে। আস্তিন গুটিয়ে পরা মাকরূহ।
৯৷ যে ধরণের পোশাক পরে মানুষ জনসমক্ষে যায় না সে ধরণের পোশাক পরে নামাজ পড়া মাকরূহ।
৩য় ফরজঃ কিরাত করা
১৷ যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করবে তখন এক এক আয়াত থেমে থেমে পড়বে। প্রত্যেক আয়াতের শেষে নিঃশ্বাস ছেড়ে দেবে। যেমন- আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন (থামবে)। আর রাহমানির রাহীম (থামবে) মালিকি ইয়াওমিদ্দীন (থামবে)। এভাবে সূরা শেষ করবে। এক নিশ্বাসে কয়েক আয়াত পড়বে না। সূরা ফাতিহা ছাড়া অপর যে কোন সূরা পাঠ করার সময় এক নিশ্বাসে এক বা একাধিক আয়াত পাঠ করা যায়।
২৷ বিনা কারণে শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করবে না।
৩৷ উভয় পায়ের উপর সমান ভার রেখে দাঁড়াতে হবে।
৪৷ হাই তোলা বা চুলকানো থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকার চেষ্টা করবে। যদি বিরত রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে হাত বাঁধা অবস্থায় ডান হাতের পেট দিয়ে মুখ বন্ধ করবে। অন্য অবস্থায় বাম হাতের পিঠ দিয়ে মুখ বন্ধ করবে।
৫৷ দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদাহর স্থানে রাখবে। এদিক ওদিক দেখা বা সামনের দিকে দেখা থেকে বিরত থাকবে।
৪র্থ ফরজঃ রুকূ করা
৪র্থ ফরজঃ রুকূ করা। রুকূর মধ্যেঃ
১৷ শরীরের উপর অংশকে ঝুঁকাবে যাতে করে গর্দান ও পিঠ এক বরাবর হয়, এর চেয়ে বেশী ও কম করবে না।
২৷ রুকূ অবস্থায় গর্দান এতটুকু ঝুঁকাবে না যাতে থুতনী সীনার সাথে মিশে যায়। আবার এতটুকুও উপরে রাখবে না যাতে করে গর্দান ও কোমর এক বরাবর হয়ে যায়।
৩৷ রুকূর মধ্যে পা সোজা রাখবে, পা যেন বাঁকা না হয়।
৪৷ পায়ের নলা সোজা খাড়া রাখবে, সামনে বা পিছনে ঝুঁকবে না।
৫৷ রুকূতে যাওয়ার সময় হাত সোজা ছেড়ে দেবে না বা পিছনের দিকে ঝাড়া দেবে না।
৬৷ উভয় হাত হাঁটুর উপর এমনভাবে রাখতে হবে যাতে আঙুলগুলো খোলা থাকে এবং দুই আঙ্গুলের মাঝখানে ফাঁক থাকে। এভাবে ডান হাত দ্বারা ডান হাঁটু এবং বাম হাত দ্বারা বাম হাঁটু শক্তভাবে ধরবে।
৭৷ রুকূকালীন সময়ে হাত ও বাহু সোজা থাকা চাই কোন অবস্থাতেই যেন বক্রতা না আসে। পাজড় থেকে বাহুকে পৃথক রাখবে।
৮৷ রুকূকালীন সময়ে দৃষ্টি উভয় পায়ের মধ্যবর্তী স্থানের ওপর রাখবে।
৯৷ রুকূতে স্থিরতার সাথে ততক্ষণ দেরী করবে, যাতে কমপক্ষে ৩ বার 'সুবহানা রাব্বিয়াল আজীম' পড়বে। সম্ভব হলে ৫, ৭ ও ৯ বার পড়া উত্তম।
১০৷ উভয় পায়ের ভারসাম্য সমান থাকবে এবং গোড়ালী দুইটি পাশাপাশি থাকবে। আগে পিছে নয়।
রুকূ থেকে দাঁড়ানোর সময়ঃ
১৷ রুকূ থেকে দাঁড়ানোর সময় এভাবে সোজা হবে যাতে শরীরে কোথাও বক্রতা না থাকে। হাত নিচের দিকে ছেড়ে সোজা রাখবে।
২৷ এ সময়ও দৃষ্টি সিজদাহর স্থানে রাখবে।
৩৷ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে রুকূ থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সিজদাহে যেতে হবে।
৫ম ফরজঃ সিজদাহ করা
৫ম ফরজঃ সিজদাহ করা। সিজদাহে যাওয়ার সময়ঃ
১৷ প্রথমে হাঁটু বাঁকা করে জমিনের দিকে এমনভাবে নিয়ে যাবে যাতে সীনা ও মাথা আগে না ঝুঁকে। যখন হাঁটু মাটিতে লেগে যায় তখন সীনা ও মাথা ঝুঁকাতে হবে।
২৷ হাঁটু জমিনে ঠেকাবার আগ পর্যন্ত শরীরের উপরের অংশ সামনের দিকে ঝুঁকাবে না।
৩৷ সীনা সামনের দিকে না ঝুঁকার নিয়ম যেমন- সিজদাহে যাওয়ার সময় হাঁটুর উপর হাত দিয়ে ভর না দেয়া, এতে হাঁটু মাটিতে লাগার পূর্বে সীনা ও মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে যায়।
মাথা ও সীনা না ঝুঁকানোর কারণ
১৷ সিজদাহে যাওয়ার সময় হাঁটু মাটিতে লাগার পূর্বে নিজ কোমর, বুক তথা শরীরের উপরিভাগ সম্পূর্ণ সোজা রাখতে হবে।
২৷ সিজদাহে যাওয়ার সময় হাঁটুতে হাত রাখার কোন প্রমাণ নেই। তবে সিজদাহ থেকে উঠার সময় হাঁটুতে হাত রাখা মুস্তাহাব।
৩৷ হাঁটুর পর প্রথমে জমিনের উপর হাত, তারপর নাক, অতঃপর কপাল রাখবে।
সিজদাহ অবস্থায়
১৷ সিজদাহতে মাথা উভয় হাতের মাঝখানে এমনভাবে রাখবে, যাতে উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলীর মাথা কান বরাবর হয়। উভয় হাতের মাঝে চেহারার আকার পরিমাণ ফাঁক রাখবে।
২৷ সিজদাহে উভয় হাতের আঙুলগুলো পরস্পর মিলে থাকবে। আঙ্গুলের মাঝখানে যেন কোন ফাঁক না থাকে।
৩৷ সিজদাহে উভয় পায়ের গোড়ালী কাছাকাছি রাখবে মিলিয়ে রাখবে না এবং আঙ্গুলের মাথাগুলো কিবলামূখী থাকবে।
৪। উভয় হাতের কনুইদ্বয় জমিন থেকে উপরে থাকবে।
৫। উভয় বাহু বগল থেকে পৃথক রাখা চাই, বগল ও বাহু মিলিয়ে রাখবে না।
৬। কনুইদ্বয়কে এত দূরে রাখতে হবে যাতে পাশের নামাজীর কোন অসুবিধা না হয়।
৭। পেট ও রান আলাদা আলাদা রাখবে। পেট ও রান মিলিয়ে রাখবে না।
৮। সম্পূর্ণ সময় সিজদাহর মধ্যে নাক মাটির সাথে মিলিয়ে রাখবে। মাঝে মধ্যে তুলে ফেলা ঠিক নয় এবং নাকের অগ্রভাগে দৃষ্টি রাখতে হবে।
৯। উভয় পা এমনভাবে খাড়া রাখবে যেন পায়ের গোড়ালী উঁচু থাকে এবং আঙ্গুলগুলো মোড় দিয়ে কিবলামূখী থাকে।
১০। সিজদাহর সময় উভয় পা পূর্ণ সময় জমিনের সাথে লাগানো থাকবে। সিজদাহে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় পা মাটিতে না রাখলে সিজদাহ আদায় হয় না।
১১। সিজদাহে কমপক্ষে এতক্ষণ অবস্থান করবে যাতে কমপক্ষে ৩ বার 'সুবহানা রাব্বিয়াল আলা' পড়া যায়। সম্ভব হলে ৫, ৭ ও ৯ বার পড়া উত্তম।
দুই সিজদাহর মধ্যখানে
১। প্রথম সিজদাহ থেকে উঠে ধীরস্থিতার সাথে দোজানু হয়ে সোজা বসবে। অতঃপর দ্বিতীয় সিজদাহ করবে।
২। বাম পা বিছিয়ে তার ওপর বসবে এবং ডান পা এভাবে খাড়া রাখবে যেন আঙ্গুলগুলো মুড়িয়ে কিবলার দিকে থাকে।
৩। বসা অবস্থায় উভয় হাত রানের অগ্রভাগে হাঁটুর সমানে রাখবে, আঙ্গুলগুলো যেন হাঁটুর উপর লটকানো না থাকে। আঙ্গুলগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় সামান্য ফাঁক থাকবে।
৪। বসা অবস্থায় দৃষ্টি নিজ কোলের মধ্যবর্তী স্থানের দিকে থাকবে।
দ্বিতীয় সিজদাহ থেকে উঠা
১। দ্বিতীয় সিজদাহেও এভাবে যেমন প্রথমে উভয় হাত তারপর নাক অতঃপর কপাল মাটিতে রাখবে।
২। দ্বিতীয় সিজদাহ ও প্রথম সিজদাহর মতই হবে।
৩। সিজদাহ থেকে উঠার সময় প্রথমে কপাল তারপর নাক তারপর হাত অতঃপর হাঁটু মাটি থেকে উঠবে।
৪। সিজদাহ থেকে উঠার সময় হাঁটুর উপর হাত ভর দিয়ে উঠবে। বসা ছাড়াই মাটিতে ভর না দিয়ে সরাসরি দাঁড়াবে। তবে শরীরের ওজনবৃদ্ধি বা রোগ-ব্যাধি অথবা বার্ধক্যের কারণে শরীর দুর্বল হলে মাটিতে ভর দেয়া যায়।
৬ষ্ঠ ফরজঃ শেষ বৈঠক করা
৬ষ্ঠ ফরজঃ শেষ বৈঠক করা। বসা অবস্থায়ঃ
১। দুই সিজদাহর মাঝখানে বসার অনুরূপে দুই রাকাত পর বসবে। বসা অবস্থায় দৃষ্টি নিজ কোলের দিকে রাখবে।
২। তাশাহ্হুদ পড়ার সময় 'লাইলাহা' বলার সময় তর্জনী তুলে ইশারা করবে, তর্জনীর মাথা যেন কিবলামূখী থাকে এবং ইল্লাল্লাহু বলার সময় আঙ্গুল নামিয়ে ফেলবে।
৭ম ফরজঃ নামাজ হতে বাহির হওয়া
৭ম ফরজঃ নামাজ হতে বাহির হওয়া। সালাম ফিরানোর সময়ঃ
১। উভয়দিকে সালাম ফিরানোর সময় গর্দান এতটুকু ঘুরাবে যাতে পিছনে বসা ব্যক্তি যেন চোয়াল দেখতে পায়।
২। সালাম ফিরানোর সময় দৃষ্টি কাঁধের ওপর রাখবে।
মোনাজাতের সময়
১। দোয়া করার সময় উভয় হাতের মাঝখানে সামান্য ফাঁক থাকবে। আঙ্গুলগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় ফাঁক থাকবে।
২। দোয়া করার সময় হাত সীনা বরাবর তুলবে এবং হাতের তালু চেহারার দিকে রাখবে। দৃষ্টি দুই হাতের মধ্যখানে থাকবে।
তঃ আশা করি টিউনটি আপনার কাছে ভালো লেগেছে। এবং আপনার মন থেকে ভুল ধারণা দূর হয়ে গেছে। এবং পরবর্তীতে কোন টপিক নিয়ে টিউন চান সেটা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। খোদা হাফেজ।।